এক ডানা ভাঙা শালিক পাখির সুরে প্রজন্মের তরে যে মানুষটি গোটা জীবন আগুনের কথা বলেছেন, গানে গানে শুনিয়েছেন রঙিন হৃদয়ের সমস্ত দাবি, তিনি সঞ্জীব চৌধুরী৷ বেঁচে থাকার প্রতিটি সময় দলছুট ভাবনার সাথে তাঁর অন্তরঙ্গ মিশে থাকার গল্প বাংলা গানের জগতকে সম্পূর্ণ নতুন এক মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছিল৷ প্রিয় পাঠক, আজন্ম অন্তরের কথা বলতে চাওয়া এই কিংবদন্তী শিল্পীর জীবন ও সৃষ্টি নিয়ে চলুন একটু জেনে আসা যাক৷ ১৯৬৪ সালের আজকের এই দিনে হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার মাকালকান্দি গ্রামে সঞ্জীব চৌধুরীর জন্ম হয়৷ পিতা গোপাল চৌধুরী এবং মা প্রভাষিণী চৌধুরীর নয় ছেলে-মেয়ের মধ্যে সঞ্জীব ছিলেন সপ্তম সন্তান৷ বাড়িতে তাঁর ডাকনাম ছিল কাজল৷ বসতভিটা বানিয়াচংয়ে হলেও জানা যায় তাঁদের মূল বাড়ি ছিল সিলেট জেলার বিশ্বনাথ থানার দশঘর গ্রামে৷ তাঁর পিতামহ শরৎ রায় চৌধুরী সেখানকার জমিদার ছিলেন ৷ হবিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করে সঞ্জীব চৌধুরী ঢাকায় চলে আসেন৷ ঢাকায় এসে বকশীবাজারের নবকুমার ইন্সটিটিউটে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই ১৯৭৮ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে মেট্রিক পাশ করেন৷ ছাত্রজীবন থেকেই সঞ্জীব চৌধুরী তুখোড় মেধাবী হিসেবে পরিচিত ছিলেন ৷ মাধ্যমিক পরীক্ষায় জাতীয় মেধাতালিকায় ১২তম হয়ে তিনি ঢাকা কলেজে ভর্তি হবার পর পর তাঁর জীবন-দর্শনের আমূল পরিবর্তন ঘটে ৷ বলা যায়, ঢাকা কলেজের ক্যান্টিন থেকেই সঞ্জীব চৌধুরীর সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির হাতেখড়ি হয়েছিল৷ অসম্ভবের পৌরুষোদ্দীপ্ত কন্ঠে সত্তরের দশকের অকালপ্রয়াত লেখক, ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী খান মোহাম্মদ ফারাবীর রচনা থেকে প্রায়ই আবৃত্তি করতেন— আমি তো তাদেরই জন্য, সূর্যের দিকে চেয়ে থাকবার অভ্যাসে যারা বন্য! আমি তো তোমারই জন্য, কপাল রাঙানো যে মেয়ের টিপ রক্তের ছোপে ধন্য! আস্তে আস্তে সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকতে থাকা অবস্থায় কবিতার বই হাতে কলেজ ক্যান্টিনের তুমুল আড্ডার দিনগুলিই ছিল তাঁর মৌলিক বিকাশের মূল সময়৷ তখনকার উত্তাল দিনগুলির সাথে পাল্লা দিয়ে সঞ্জীবও যেন ছুটছিলেন আগুনের ফুলকি বুকে নিয়ে৷ ১৯৭৯-৮০ সালের ঢাকা কলেজ ছাত্র ইউনিয়ন সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন৷ তারপর ১৯৮০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন এবং সেই বছরই স্নাতকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে ভর্তি হয়ে যান৷ বিজ্ঞানের এই তুমুল মেধাবী ছাত্রটির, কোনো এক অজানা কারনে গণিত বিভাগে পড়া চালিয়ে যেতে ইচ্ছে করল না৷ তারপর ভর্তি বাতিল করে তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণসংযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে ভর্তি হন৷ এবং সেখান থেকেই গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে মাস্টার্স পাশ করেন৷ বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আশির দশক বেশ উত্তপ্ত এক সময়৷ স্বৈরাচারী সরকারের শাসন মেনে না নেয়া হাজার হাজার স্বাধীনচেতা তরুণের মতো সঞ্জীব চৌধুরীও বিক্ষোভ বিপ্লবের দিকে জীবনকে ঠেলে দিয়েছিলেন৷ এভাবেই আন্দোলন সংগ্রামের ভেতর দিয়ে নিজের জীবনকে পোড়াতে পোড়াতে দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে খাঁটি এক শিল্পীমন সঞ্জীব চৌধুরীর আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল৷ ছাত্রজীবনে সঞ্জীব শঙ্খচিল’ নামে একটি গানের দলের সাথে জড়িত ছিলেন৷ স্বৈরাচারী সরকার-বিরোধী আন্দোলনকারী সংস্কৃতি-কর্মীদের প্রতিটি সাংস্কৃতিক বিপ্লবসূচক প্রচেষ্টা আমাদের জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে ইতিহাসে বিবেচিত৷ তখনকার বিভিন্ন সভা-সমাবেশে গান গাইতেন, কবিতা পড়তেন বলে অনেকেই সঞ্জীব চৌধুরীকে চিনতেন৷ কিন্তু গায়ক হিসেবে তখনও তিনি এতটা নাম কুড়াননি। পড়াশোনার পাট চুকিয়েই তিনি সাংবাদিকতা পেশায় মনোনিবেশ করেছিলেন। দৈনিক উত্তরণ ছিল তাঁর প্রথম কর্মস্থল৷ তারপর একে একে ‘ভোরের কাগজ’, ‘আজকের কাগজ’, ‘যায় যায় দিন’ পত্রিকায় তিনি সাংবাদিকতা করেছেন৷ গদ্য ও কবিতা উভয় ক্ষেত্রেই সঞ্জীব চৌধুরী ছিলেন অসামান্য এক সৃজনশীল প্রাণ। তিনি ১৯৮৩ সালের একুশে বইমেলায় ‘মৈনাক’ নামে একটি লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদনা ও প্রকাশ করেছিলেন৷ এরপর ১৯৯০ সালে লোকালয় প্রকাশনী থেকে তাঁর ‘রাশ প্রিন্ট’ নামে একটি গল্পগ্রন্থ বের হয়৷ বইটি বের হওয়ার পরপরই সমালোচক মহল থেকে দারুণ প্রসংশা কুড়িয়ে নেয়৷ কিংবদন্তী লেখক আহমদ ছফা সেই সময় সঞ্জীব চৌধুরীর লেখার দারুণ প্রশংসা করেছিলেন৷ বইটি পরবর্তীতে বাংলা একাডেমি কর্তৃক সেরা গল্পগ্রন্থও নির্বাচিত হয়৷ তখনকার সময়ে রাজধানীর শাহবাগে অবস্থিত আজিজ সুপার মার্কেট ছিল প্রগতিশীলদের দারুণ এক মিলনস্থল৷ সঞ্জীব চৌধুরীর বিস্তৃত পরিসরে গানের জগতে প্রবেশে এই আজিজ মার্কেট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল৷ সঞ্জীব মূলত গান ও আড্ডার টানে এখানে প্রায়ই আসতেন৷ একদিন আজিজ মার্কেটে তাঁর গায়ক বন্ধু হাসান আবিদুর রেজা জুয়েল তাঁকে শিল্পী বাপ্পা মজুমদারের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন৷ বাপ্পা মজুমদার এই দেশেরই কিংবদন্তী সংগীত নক্ষত্র বারীণ মজুমদারের ছোট ছেলে৷ সেই সময়ে বাপ্পা ছিলেন বয়সে তরুণ একজন মেধাবী গায়ক এবং সুরকার৷ ক্রমশই বাপ্পার সাথে সঞ্জীব চৌধুরীর হৃদ্যতা বাড়তে থাকে৷ বাপ্পার একক অ্যালবামে সঞ্জীব চৌধুরীর লেখা গান বাপ্পার কণ্ঠে গীত হয়৷ তারপর দুজন আরো বেশ কয়েকটি প্রজেক্টে একসঙ্গে কাজ করে, শেষে শিল্পকলা একাডেমিতে শিল্পী অশোক কর্মকারের প্রদর্শনীতে ২৮ মিনিটের একটি মিউজিক তৈরির সময় হঠাৎ ব্যান্ডজাতীয় একটা কিছু তৈরি করবার পরিকল্পনা আঁটেন৷ সে পরিকল্পনার ওপর ভিত্তি করেই ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্যান্ডদল ‘দলছুট’৷ ব্যান্ড তৈরি হবার ২ বছর পর ১৯৯৭ সালে দলছুটের প্রথম অ্যালবাম ‘আহ’ প্রকাশিত হয়৷ ‘আহ’ অ্যালবামটি শ্রোতাদের জন্য এক ভিন্নতার স্মারক হয়ে এলেও, প্রকাশের প্রায় আটমাস পর বিটিভির ‘শুভেচ্ছা’ অনুষ্ঠানে এই অ্যালবামের রঙ্গিলা গানটির মিউজিক ভিডিও প্রচারিত হলে, অ্যালবামটি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল৷ ‘আহ’ অ্যালবামের ‘নিষিদ্ধ’ নামের আরেকটি গান বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল৷ সঞ্জীব চৌধুরীর কথায় বাপ্পা ও সঞ্জীব মিলে গেয়েছিলেন— কণ্ঠ নিষিদ্ধ সুর নাই যন্ত্র নিষিদ্ধ বাদ্য নাই আমাদের গানের আদেশ নাই ও গান গাওয়ার নিয়ম নাই... আকাশ নিষিদ্ধ পক্ষী নাই বৃক্ষ নিষিদ্ধ পুষ্প নাই আমাদের মনে উড়াল নাই উড়াল প্রজাপ্রতি নাই এরপর ২০০০ সালে দলছুটের সবচেয়ে বিখ্যাত অ্যালবাম ‘হৃদয়পুর’ প্রকাশিত হয়৷ এই অ্যালবাম প্রকাশের পরপরই শ্রোতাদের অন্তরে ব্যান্ড ‘দলছুট’ এক স্থায়ী প্রেম রূপে নিজেদের আসন পাকা করে নেয়। এই অ্যালবামের ‘গাড়ি চলে না’, ‘বাজি’, ‘চাঁদের জন্য গান’, ‘তোমাকেই বলে দেব’ গানগুলো দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল ৷ সঞ্জীব চৌধুরীর ছিলেন চির বোহেমিয়ান৷ জীবনের পরতে পরতে অন্বেষণ আর স্বাধীনতার চিন্তায় সঞ্জীব কখনো জীবনকে জটিল করেননি৷ বরং ছেড়ে দিয়েছেন৷ সহজ জীবন শুধু বিপ্লবী থেকেই ক্ষান্ত হয়নি৷ বোকা, অভিমানী প্রেমিকও সেজেছেন সময়ের প্রয়োজনে৷ সঞ্জীব গেয়েছেন— আমি তোমাকেই বলে দেব কি যে একা দীর্ঘ রাত আমি হেঁটে গেছি বিরান পথে আমি তোমাকেই বলে দেব সেই ভুলে ভরা গল্প কড়া নেড়ে গেছি ভুল দরজায় ছুঁয়ে কান্নার রং, ছুঁয়ে জোছনার ছায়া’ এই চির অভিমানী প্রেমিক সঞ্জীবই আবার গেয়েছেন— ‘কে আমাকে হাত ধরে নিয়ে এলো তোমার উঠানে আমি যে বসেই আছি খোল দরজা, বলি খোল দরজা আমি রাগ করে চলে যাব ফিরেও আসব না আমি কষ্ট চেপে চলে যাব খুঁজেও পাবে না মেয়ে আমাকে ফেরাও দলছুটের ৩য় অ্যালবাম ‘আকাশচুরি’ প্রকাশিত হয় ২০০২ সালে ৷ এই অ্যালবাম থেকে ‘হৃদয়ের দাবি’, ‘ফিরে পেতে চাই’, ‘কার ছবি নেই’, ‘এই নষ্ট শহরে’, ‘বায়োস্কোপ’—গানগুলো আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে৷ কামরুজ্জামান কামুর লেখা ‘হৃদয়ের দাবি’ গানটি সঞ্জীব ছাড়া অন্য কারো গলায় সম্ভবত কোনোদিনই মানাত না৷ একজন সঞ্জীব চৌধুরীর হৃদয়ের অতলান্ত নিংড়ে বেরিয়ে আসা সুরে আত্মকথাকে গেঁথে কাউকে বলে দেবার যে তাড়না এই গানে উঠে এসেছে তাতে শ্রোতারা এক অদ্ভুত মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছেন বারবার৷ মায়ায় জড়িয়েই টের পেয়েছেন সঞ্জীব যেন তাদের কথাই একের পর এক নতুন গানে উঠিয়ে নিয়ে আসছেন৷ প্রশ্ন আর উত্তরের অতীতে আমাদের একান্ত যে ডুবে যাওয়া সেখানে ডুবে যেতে যেতে আবার সঞ্জীবই গাইছেন— তীর হারা এই দুঃসময়ে স্বপ্ন ডাক দেয় হাতছানিতে যাই হারিয়ে আঁধার অচেনায় আমার গানের সাথে তোমার গান মেলাও চতুর্থ অ্যালবাম ‘জোছনাবিহার’-এর পর সঞ্জীব এবং বাপ্পা দুজনই আলাদাভাবে নিজস্ব ক্যারিয়ারের দিকে ঝুঁকে পড়েন৷ তবে সঞ্জীবের একক অ্যালবাম ‘স্বপ্নবাজি’র গানগুলো শুনলেই সত্যিকারের সঞ্জীব চৌধুরীর দেখা মেলে৷ ওই অ্যালবামে আমরা দেখেছি কামরুজ্জামান কামু, জুলফিকার রাসেল, টোকন ঠাকুর, আনিসুল হক, প্রজ্ঞা নাসরিন, জাফর রাশেদ, গিয়াস আহমেদ—যারা ছিলেন তখনকার সব তরুণ কবি তাঁদের লেখা থেকে গান করেছেন৷ তরুণদের মাঝেই নিজেকে এমনভাবে খুঁজেছেন যে লোকটি সে লোকটি চঞ্চল প্রেমের প্রজাপতি হয়ে বিপরীত রিকশায় চলে যাওয়া সুন্দরী তরুণীর প্রতি গেয়েছেন ‘রিকশা যাচ্ছে হাওয়ায় উড়ে, আমার হৃদয় তুচ্ছ করে... রিকশা কেন আস্তে চলে না?’ আবার অনন্ত রাত্রির বিষাদে তাঁরই কণ্ঠ ভারি হয়েছে৷ উচাটন মন নিয়ে, চির বিরহী সঞ্জীব গেয়েছেন— কথা বলব না আগের মতো কিছু নেই পিছু ডাকব না পিছু ডাকার কিছু নেই সর্বনাশী ঝড়ের বুকে উড়ে যাবার কিছু নেই আগুনে পুড়েছি এ হাত বাড়িয়ে পুড়ে যাবার কিছু বাকি নেই শুধু তারুণ্যের গানই গাননি এই চির স্বাপ্নিক শিল্পী৷ গেয়েছেন সাতাশ বছর বয়সী সাহসী যুবকের গানও৷ যার বুকে স্বপ্ন ভাঙার শঙ্কা নেই, তার চোখে জীবন মঞ্চের জটিল দৃশ্যায়নের ইতিবৃত্ত সময়কে মুঠোবন্দী করবার প্রেরণা দেয়৷ সঞ্জীব গেয়েছেন— আমার বুক দেখাব তোকে বুকে রয়েছে বিদ্যুৎ কিছু করলি মনে ধুৎ আমি খেয়েছি স্বপ্নকে জানিস বজ্র সখা আমার আমার সাধ এখানে থামার তোর আঁচল পেলে বাতাস আর দরকার কী নামার আমার বয়স হলো সাতাশ আমার সঙ্গে মিতা পাতাস, তোর দু’হাত চেপে ধরি চাই এটুকু মাত্তরি অসীম সাহসী এই শিল্পী শুধু স্বপ্নের কথাই তাঁর গানে বলেননি৷ রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক নানা অনাচারের বিরুদ্ধে তিনি যে সদা একজন সদা জাগ্রত কণ্ঠস্বর ছিলেন সে প্রমাণও তাঁর গানে আমরা পেয়েছি৷ শুভাশিস সিনহার কথায়, নিজস্ব সুরে তিনি গেয়েছেন— ওই কান্নাভেজা আকাশ আমার ভাল লাগে না থমকে থাকা বাতাস আমার ভাল লাগে না তুড়ির তালে নাচতে থাকা ভাল লাগে না এই মরে মরে বেঁচে থাকা ভাল লাগে না পুলিশের হাতে ধর্ষিত হয়ে খুন হওয়া ইয়াসমিনকে নিয়ে তিনি ছাড়া আর কেউ গাননি— ওরে রক্তচোষা ডাকলো পেঁচা অলক্ষুণে রাত আসে অন্ধকারে চুপিসারে ভীষণ কালো হাত লোল ছেড়ে তার লোলুপ জিহ্বা ছিঁড়ল হৃদয় বিণ আহ ইয়াসমিন আহ ইয়াসমিন আহ ইয়াসমিন তাঁর ছিল এক কবির হৃদয়, যে হৃদয় সুরেই খুঁজে পেত জীবনের সত্য সুখ৷ কখনো দৃশ্যে, কখনো অদৃশ্যে জীবনকে উদযাপনে মগ্ন এই শিল্পীর চির বোহেমিয়ান চিন্তা জগৎ সর্বদাই জনমানুষের কাছাকাছি এসেই শিল্পের মানে খুঁজে পেয়েছে৷ সঞ্জীব চৌধুরীকে সব্যসাচী বলা যায় এক অর্থে৷ যেমন করে গান গেয়েছেন, সাংবাদিকতাও করেছেন তার সাথে পাল্লা দিয়ে৷ গান তো লিখেছেনই, গদ্য পদ্যের মতো নাটকের স্ক্রিপ্টও লিখেছেন এই মেধাবী মানুষটি৷ ‘সুখেরও লাগিয়া’ নামে একটি নাটকে অভিনয় করার অভিজ্ঞতাও ছিল তাঁর৷ সঞ্জীব গুণীর কদর করতে জানতেন৷ ‘হৃদয়পুর’ অ্যালবামে ‘গাড়ি চলে না’ গানটি গাওয়ার আগে শাহ আবদুল করিমের অনুমতি নিয়েছেন তিনি৷ তাঁর গানে যে রুচিশীলতার, গভীর বোধের দিকটি ধরা পড়ে তার কারণ অ্যাল স্টুয়ার্ট, পিংক ফ্লয়েড, বব ডিলান তাঁর গান শোনার জীবনকে আলোকিত করেছে৷ তিনি বাংলাদেশ, মরক্কো, স্পেনের লোকসংগীত দ্বারাও প্রচুর আকৃষ্ট ছিলেন৷ রোমান্টিক এই মানুষটি খন্দকার আলেমা নাসরিন শিল্পীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন৷ সঞ্জীব-শিল্পীর একমাত্র কন্যা কিংবদন্তীর জন্ম ২০০৪ সালের ১৮ মে৷ ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর হঠাৎ বাইলেটারেল সেরিব্রাল স্কিমিক স্ট্রোকে আক্রান্ত হন সঞ্জীব চৌধুরী৷ ওই দিন প্রচণ্ড অসুস্থ বোধ করার পর তাঁকে চিকিৎসার জন্য ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি করা হয়৷ আইসিইউতে থাকাকালীন সেখানেই ১৯ নভেম্বর ২০০৭ তারিখে মাত্র ৪৩ বছর বয়সে এই মহান শিল্পী মৃত্যুবরণ করেন৷ চিরকাল শিল্পে মানুষের কথা এই মহান শিল্পী মৃত্যুর পরেও নিজেকে মানুষের সেবাতেই নিয়োজিত রাখতে চেয়েছিলেন৷ ঢাকা মেডিকেল কলেজকে দান করে দেয়া তাঁর কঙ্কালটি এখন চিকিৎসাবিজ্ঞান পড়ুয়া ছাত্রদের পড়ার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে৷ বেঁচে থাকার প্রতিটা সময় শুধু কাজ করে যাওয়া এই আপোসহীন, গুণী শিল্পীকে মানুষ তাঁর কাজেই হয়তো মনে রাখবেন৷ তাঁর স্বপ্নবাজি করে কাটিয়ে যাওয়া একেকটা মুহূর্ত এখনকার তরুণদের কী প্রবল অনুপ্রাণিত করে অন্তরের কথা বলবার তাগাদা দেয় তা রাত বাড়লে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হল থেকে, আড্ডার কিনারা থেকে ভেসে আসা গিটারের সুর, আবেগমথিত গলার গান শুনেই অনুভব করা যায়৷ ছিলেন জমিদার পরিবারের সন্তান৷ তবু চিরকাল লালন করেছেন সাম্যবাদের সুদিনের স্বপ্ন৷ তথাকথিত প্রশাসন হয়তো বারবার তাঁর দিকে চোখ রাঙিয়েছে, তবু তিনি দমে যাননি৷ শক্তিশালী ডানা নিয়ে পারলেই উড়ে গিয়েছেন স্বাধীনতা নামক ঝকঝকে নীল আকাশে৷ সঞ্জীব নেই—এ কথা আজ কে বলবে? চোখ পুড়ে যায়, যাক৷ চোখ সমুদ্র সাজে, সাজুক ৷ সঞ্জীব আছেন, সঞ্জীব থাকবেন সারাজীবন৷
top of page
bottom of page
Comments